ধর্মের বিরুদ্ধে অনেকেই অনেক লেখা লেখেন, কিন্তু অধিকাংশ লেখাতেই একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। আসলে ধর্মের উৎপত্তির কারণ যদি আমরা খুঁজে বের করতে না পারি তাহলে কেবল ধর্মগ্রন্থের লাইন তুলে দিয়ে ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা করে শত শত পাতা লিখলেও ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইটা জেতা সম্ভব নয়। তাই দরকার ধর্মের একটি বস্তুবাদী বিশ্লেষণ।

পৃথিবীকে বাস্তবসম্মতভাবে দেখা, কোন রুপ অলৌকিক ও অবাস্তব বিষয় দিয়ে পৃথিবীকে বিশ্লেষণ না করাই হচ্ছে বস্তুবাদ। আর ভাববাদ হচ্ছে বাস্তবের বিকৃত উপস্থাপনা। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ভাববাদের দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখে থাকে।

বিষয়গত বা বাস্তববাদী জ্ঞান থেকে বিপরীত ধারায় ঐতিহাসিক বিকাশের মধ্যে ধর্ম দেখা দিয়েছিল। ধর্ম ছিল বাস্তবতার একটা অসম্ভব, আজগুবি ও বিকৃত প্রতিফলন, বাস্তবতার বিকৃত ব্যাখ্যা। বিজ্ঞানের এত বিপুল অগ্রগতি সত্ত্বেও সেই ধর্ম আপাতত টিকে আছে।

ধর্মের মর্ম বুঝতে হলে স্পষ্ট করে তুলে ধরা দরকার কেন ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল, আর সমাজ জীবনে আর জীবনের বিকাশে এর ভূমিকা কি।

ধর্ম কোন দৈব প্রত্যাদেশ থেকে উৎপন্ন হয়নি, কোন অলৌকিক জগতের প্রতিফলনও নয়। মানুষের নানা ধরনের চেতনা রয়েছে, ধর্মও সামাজিক মানুষের চেতনায় বাস্তবতার একটা প্রতিফলন, ধর্ম কোন স্বর্গীয় নয় পার্থিব বস্তু। কোন অর্থেই ধর্ম মানুষের সহজাত নয়। আদিম মানুষের কখনও কোন নিহিত ধর্মীয় চেতনা বা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক মনোবৃত্তি ছিল না। গত শতকে আদিম ইতিহাস সম্বন্ধে একজন নেতৃস্থানীয় ফরাসী অধ্যয়নকারী গ্যাব্রিয়েল মতিরলে প্রমাণ করেছিলেন যে, প্রত্নপ্রস্তরযুগের শুরুর দিকে আদৌ কোন রকমের ধর্মীয় উপাদান ছিল না। (Mortillet, 1883)

কার্ল মার্ক্স-এর পূর্বে কোন কোন বস্তুবাদী খুব সরলভাবেই বলেছিলেন, অজ্ঞ ও সরলবিশ্বাসী মানুষকে ধোঁকা দিতে গিয়ে মুষ্টিমেয় ধাপ্পাবাজ কিছু লোক ধূর্ততার সাথে ধর্ম-কে খাড়া করেছিল, এটা আংশিক সত্য কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য নয়। অজ্ঞতা ধর্মের একটা মিত্র আর ধাপ্পাবাজি ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তবে ধর্মের আসল উৎপত্তিস্থল অন্যত্র।

মানুষ যখন শ্রমের ভিতর দিয়ে বহিঃপ্রকৃতি থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল অথচ তখনও মোটের উপর প্রায় ষোল-আনাই নির্ভরশীল ছিল প্রাকৃতিক ভৌত শক্তিগুলোর উপর, ঠিক তখনই ধর্মের দেখা দিয়েছিল।

ধর্ম দেখা দেয় উৎপাদন শক্তির বিকাশের একটা নিম্ন পর্যায়ে,- উৎপাদনী শক্তি বিকাশের সর্বনিম্ন পর্যায় সমেত অন্য কোন পর্যায়ে ধর্মের উদ্ভব ঘটতে পারে না। ধর্মের উদ্ভবের সাথে উৎপাদন শক্তির সরাসরি সম্পর্ক আছে। যে কোন নির্দিষ্ট কাল পর্যায়ে উৎপাদনী শক্তি বিকাশের মাত্রা থেকে বোঝা যায় প্রকৃতির উপর মানুষের কর্তৃত্ব কতটা শুধু তাই নয়, আরও বোঝা যায় প্রকৃতির উপর মানুষের নির্ভরশীলতা কতটা। কার্ল মার্কস লিখেছিলেনঃ ‘প্রযুক্তিতে প্রকাশ পায় প্রকৃতির সাথে মানুষের মোকাবিলা করার প্রণালী- যার নাম উৎপাদনপ্রক্রিয়া। মানুষ এই উৎপাদনপ্রক্রিয়া দিয়ে নিজেদের জীবনধারণ করে, আর এইভাবে উৎপাদনপ্রক্রিয়া খুলে ধরে মানুষের সামাজিক গঠনপ্রণালী।‘(Marx, 1965)

এঙ্গেলস বলেছেন,’সমস্ত ধর্মই, মানুষের মনে তাঁর দৈনন্দিন জীবনের নিয়ামক বহিঃশক্তিগুলোর উদ্ভট প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়- মানুষের মনে পার্থিব শক্তিগুলো অলৌকিক শক্তির রুপ ধারণ করে।‘ (Engels, 1969)

গোড়ায় প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে মানুষ অলৌকিক বলে ভাবত না। প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলোকে, বিশেষত যেসব প্রাকৃতিক ব্যাপার মানুষের জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে মূর্তিমান হিসেবে কল্পনা করে মানুষের জীবনে সেগুলোর সচেতন প্রভাব বিস্তার করে বলে ধরে নিত। যেসব রহস্যময় প্রাকৃতিক ভৌত শক্তিগুলোকে মানুষ বুঝতে পারত না, যেগুলোর বিরুদ্ধে মানুষ একেবারেই অসহায় ছিল, সেই শক্তিগুলোকে মানুষ তাঁর কল্পনায় মঙ্গলকর কিংবা অমঙ্গলকর, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব, দেব- দেবী, দেবদূত , শয়তান, ইত্যাদিতে রুপান্তরিত করে।

কাজেই আদিম ধর্মীয় চেতনা হল প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বর্বর মানুষের অক্ষমতাবোধের একটা প্রতিফলন।

মূলত, প্রাকৃতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর আধিপত্যই তখন ধর্মের প্রধান উৎপত্তিস্থল। মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সামাজিক শক্তিগুলোকে মোকাবেলা করতেই মানুষ ধর্মকে বেছে নেয়। ধর্ম হল মেহনতি মানুষের অক্ষম অবস্থার প্রতিফলন।

সমাজ, পরিবার ইত্যাদিতে ধর্ম মানুষের আচরণ আর কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন আইনকানুন ও বিধিনিষেধ দিয়ে যেমন- ট্যাবু, ধর্মীয় ফতোয়া এবং শরিয়া, শাস্ত্রীয় বিধান ইত্যাদি দিয়ে এবং এগুলো হাজির করা হয় বিধাতার তরফ থেকে, কাজেই সেইগুলো অলঙ্ঘনীয় বলে গন্য হয়।

মানুষের ক্রিয়াকলাপের উপর এই ধর্মীয় নিয়মতন্ত্রকে শোষক শ্রেণীগুলো তাদের আধিপত্য নিরাপদ করার জন্য ব্যবহার করে।

ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অতীতের অনেক বস্তুবাদী লেখকরাই বহু সংগ্রামী এবং প্রতিভাদীপ্ত নাস্তিকতাবাদী রচনা সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু ইতিহাস সম্বন্ধে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ধর্মের সামাজিক উৎপত্তিস্থলে তাঁদের দৃষ্টি পড়েনি, তাই তাঁরা ধর্মকে পরাজিত করার কোন পথ তাঁরা দেখাতে পারেননি।

গ্রন্থপঞ্জি